বাংলাদেশ বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে একটি ভুল সিদ্ধান্ত, কিংবা রাজনৈতিক অসচেতনতা ভবিষ্যতের গোটা রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে—এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলেও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলার শৈথিল্য, আমলাতান্ত্রিক জড়তা, রাজনৈতিক সংস্কারে অনীহা এবং পুরোনো দলগুলোর চিরাচরিত দায়হীন আচরণ আবারও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
এই অভ্যুত্থানের ভেতরে নানা পক্ষের মধ্যে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। অথচ এই গণআন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের কুশলী পরিকল্পনার ফসল ছিল না। বরং এটি ছিল দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনতার সঞ্চিত ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ।
২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্টে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রায় দুই হাজার মানুষ শহীদ হন, আহত হন ত্রিশ হাজারেরও বেশি। এর বাইরে মিথ্যা মামলা, গুম, হত্যা ও জেল-জুলুমের শিকার হাজারো মানুষ ও পরিবার ছিল এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে জমে থাকা ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি।
এক বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ ও আহতদের পরিবারের জীবনযুদ্ধ আজও থামেনি। কাগজপত্র হাতে নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাসপাতালে, থানায়, প্রশাসনের দপ্তরে—ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসনের আশায়। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও, সেগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে পুরোনো হয়রানির হাতিয়ারেই রূপ নিচ্ছে।
চিকিৎসাসেবার অভাবে শুরুর দিকে আহতদের অনেকে মৃত্যুবরণ করলেও, পরবর্তীতে কিছু উন্নয়নমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে "জুলাই ফাউন্ডেশন" নামের কাঠামোগত সহায়তা কার্যক্রম মোটের ওপর হতাশাজনকই থেকে গেছে।
এদিকে, যারা গত ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে জড়িত ছিলেন, কিংবা জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই প্রশাসনের গাফিলতিতে বিদেশে পালিয়ে গেছেন, আবার কেউ কেউ এখনও ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই রয়েছেন—এমনকি কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। এতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের পতনের পরেও একটি অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো এখনো সক্রিয় রয়েছে।
এ সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোও আহত ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং তারা নিজেরাই অভ্যন্তরীণ বিভাজন, সংস্কারহীনতা ও দিশাহীন কৌশলে নিজেদের কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারেনি।
জুলাইয়ের পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মানস গঠন ও রাষ্ট্রপুনর্গঠনের সুস্পষ্ট রূপরেখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, প্রতিটি দল নিজস্ব স্বার্থে রাষ্ট্র কল্পনা করছে। কেউ ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে, কেউবা রাষ্ট্রীয় পদলাভের সুযোগ হিসেবে।
বিশেষত বিএনপি গত কয়েক বছরের পুরোনো ৩১ দফার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপরেখা দেওয়ার বদলে তারা ঐক্যবদ্ধ রূপকল্প গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। ৭২-এর বিতর্কিত সংবিধান বাতিল করে গণপরিষদ বা গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ ছিল, যা তারা কাজে লাগাতে পারেনি।
একইভাবে জামায়াত ৪১ দফা প্রকাশ করলেও সেগুলোতে একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র কাঠামোর চিত্র পাওয়া যায়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর এই অদূরদর্শিতা ও অস্থিরতা অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাস্তবতায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Jatiyo Potrika
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের সামনে ভবিষ্যতের দায়
- আপলোড সময় : ১৪-০৭-২০২৫ ১০:৫৪:০১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-০৭-২০২৫ ১০:৫৪:০১ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ